আপ দোনো কেয়া কলকত্তে সে আয়ে? শেখ উল আলম এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের ইনোভায় তুলে চালক জাভেদ দেখলাম ভা্রি খুশি।খিদিরপুর,বাটানগর এসব জায়গায় ওর দোস্তলোগ থাকে, গেছে বারক’য়েক। এক ফাঁকে দীঘাও ঘুরে এসেছে — সমুন্দর বহুত হি বড়িয়া থা।।শুনতে শুনতে চলেছি শ্রীনগর শহরের দিকে। একে জুন মাসের ভরা ট্যুরিস্ট মরসুম, তায় সামনে বকরি ঈদ। ফলে রাস্তাঘাটের হুলুস্থুল অবস্থা।ডাল লেকের ১১নম্বর ঘাটের সামনে নিউ গুলিস্তান হোটেল পৌঁছতে পাক্কা দুঘন্টা নিল। লেকের ধার ঘেঁষে বুলেভার্ড রোডের শুরু ডাল গেট এলাকা থেকে- পরপর এক দুই করে ঘাটের নম্বর দেওয়া আছে।এখান থেকেই শিকারা ভাড়া করে সকলে লেকে ঘোরে কিংবা হাউসবোটে গিয়ে ওঠে।
মনে আছে খুব ছোটবেলায় প্রথমবার এসে এই হাউসবোটের জল খেয়ে আমার এমন পেট খারাপ হয় যে বাকি বেড়ানো লাটে উঠেছিল।দশ বছর আগে শেষ বার কাশ্মীরে এসে তাই জলে বাস করার সাহস পাইনি।সেটা ছিল শীতের সময়, ফলে বরফে মোড়া গুলমার্গ আর পহেলগাঁওর লাগাতার তুষারপাত দেখে কর্তা-গিন্নি যারপরনাই আহ্লাদিত হয়েছিলাম।তখন অনেকে বলেছিল হোয়াইট কাশ্মীর তো দেখলে, একবার গ্রিনটাও দেখে নিও গরমে এসে।এখানে সবুজের সমারোহ কেমন হতে পারে, তার আঁচ পেয়েছি বহু জায়গায়। তাই ঠান্ডায় জমে যাওয়া ন্যাড়া গাছগুলো দেখে মনে হয়েছিল আবার আসতেই হবে।গতবারের মতো এবারেও এই বেড়ানোর ব্যাপারে গোড়া থেকেই নানাভাবে সাহায্য করেছেন অনন্তনাগের বাসিন্দা ডঃ ফারুখ।ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ কলকাতার এক ডাক্তার বন্ধুর মারফৎ। যিনি ছিলেন আর.জি.কর মেডিকেল কলেজে ফারুখের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী।
দুপুরের ফ্লাইটে এসেছি ফলে হোটেলে ফ্রেস হয়ে নিয়ে বেরোতে সাতটা বাজল। দেখলাম তখনও ঝলমলে রোদ।এদিকের বাড়িগুলো সবই হোটেল, অফিস নয়তো রেস্টুরেন্ট। আর মাঝে মাঝেই হরেক জিনিষের ছোট বড় দোকান।ফুটপাথেও জামাকাপড় সাজিয়ে সব বসে পড়েছে। ট্যুরিস্টের ভিড় সর্বত্র, বেশ একটা উৎসবের মেজাজ। লেকের ধার ঘেঁষে টানা রাস্তা গেছে, হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় জলের ওপর ঢিমে হয়ে আসা সূর্যাস্তের লালচে আভা, ভেসে বেড়ানো শিকারার সিলুয়েট। ধীরে ধীরে আলোয় সেজে উঠছে দূরে সার দেওয়া হাউসবোটেরা। একটু ঠাণ্ডাও লাগতে শুরু করেছে এবার।
শ্রীনগরের দর্শনীয় হল মোঘল জমানায় তৈরি বাগানগুলো।পরদিন এক অটোওয়ালার সঙ্গে রফা করে বেরিয়ে পড়লাম।শুরুতেই বিশাল জায়গা জুড়ে জহরলাল নেহরু বোটানিকাল গার্ডেন।আগেরবারের দেখা ধুসর গাছপালাগুলো এখন কত সজীব, চারদিকে যেন সবুজের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মরশুমি ফুলও ফুটে রয়েছে থোকা থোকা। লোকজন বেড়াতে এসেছে দলে দলে। একটা বড় গাছের নিচে ছড়িয়ে বসে ছবি আঁকছে বেশ নামী স্কুল থেকে আসা নেচার স্টাডি গ্রুপের ছেলেমেয়েরা। যেই একজনের স্কেচ করেছি বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল, ওদেরও আঁকতে হবে। কী মিষ্টি আর হাসিখুশি সবাই, চেনা অচেনা বলে কিছু নেই।
একফাঁকে লাল টুপি মাথায় একটি মেয়ে আমার গিন্নির ছবি এঁকে সেটা উপহার দিল। মেয়েটির নাম মাহনুর অর্থাৎ চাঁদের আলো।এরপর শালিমার বাগ,সেই বিখ্যাত ফোয়ারাওলা বাগান। তবে কারেন্টের গণ্ডগোলে ফোয়ারা সব নিস্তেজ। ধাপে ধাপে উঠে গিয়ে বাগানের শেষ মাথায় বড় জলাশয়,পিছনে পাহাড় আর সামনে দেখা যায় ডাল লেক। জায়গাটি সব মিলিয়ে ভারী মনোরম। আমাদের অটোচালক ইজহাকভাই বেশ ঝানু আর রসিক।আমাদের দেখেশুনে ওর অকপট উক্তি…এটাই তো দোবারা রোমান্স করার বয়স। শেষমেষ নিশাত বাগ, সেকালের রাজা বাদশারা শুয়ে বসে প্রকৃতি উপভোগ করবেন বলে এসব বানিয়েছিলেন। কিন্তু সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে আমাদের ক্লান্তি আর ক্ষুধা উভয়ই তখন উর্ধমুখী।ঠিকই ছিল দুপুরের খাওয়াটা হবে এখানকার সব থেকে নামজাদা রেস্টুরেন্ট মোঘল দরবার-এ।এদের ওয়াজওয়ান-টাই খেতে আসে সবাই।পাঁচ রকম কাবাব,তিন রকম মাংসের পদ সঙ্গে পোলাও, ভাত আর স্তুপিকৃত আলুভাজা,সব মিলিয়ে এলাহি একটা ব্যাপার।
স্টুয়ার্ট সবিনয় জানাল আমাদের দুজনের জন্য কোয়ার্টার প্লেটই যথেষ্ট। তাও শেষে হাঁসফাঁস করার মতো অবস্থা, তবে খেলাম ভালোই। কাশ্মীরে ভ্যাড়ার মাংসই চলে।পাঁজরের অংশ দিয়ে বানানো কাবাব ‘তাবাকমাজ’ খেয়ে আঙুল চাটতে হল।এদের ভিতরে একটা ছোট ঘরে মাটিতে বসে প্রথাগতভাবে খাবার ও ব্যাবস্থা আছে।আপাতত দেখলাম খালি।পথেঘাটে ঘুরে ছবি আঁকতে গিয়ে চেনা জানা হয়ে যায় অনেকের সঙ্গেই, আর কাশ্মী্রি পুরুষেরা এমনিতেই বেশ আলাপী। ডাল লেকের আশে পাশে সবই নিরামিষ খাবারের দোকান,আমরা যেতাম ‘দিল্লি রসোই’ তে। ওখানে দেখাশোনা করে দশাসই চেহারার মনজুর,সবাইকে একেবারে দাবড়ে রাখে কিন্তু আমাদের দেখলেই কী খাতির। খাতা বের করে বললাম তোমার ছবি আঁকব,ও বিশ্বাসই করতে চায়না। লেকের ধারে পা ঝুলিয়ে বসা দুই বন্ধু ,আকিব আর সইফুল্লাহ-র সঙ্গেও ভাব জমল এইভাবেই।ধবধবে সাদা কুর্তা পাজাম পরা আকিব বসল আমার জন্য পোজ দিতে। স্কেচ হয়ে যাবার পর দুই বন্ধু একসঙ্গে বলে উঠল… ‘কেয়া খুব বনায়া আপনে’।
অঙ্কন : দেবাশীষ দেব
(ক্রমশ)